কানাডাযুক্তরাষ্ট্র

নারী সেনারা বদলে দিচ্ছেন সামরিক বাহিনীর কাজের ধরন

র‌্যাচেল গ্রিমস যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা হিসেবে তিন দফায় দায়িত্ব পালন করেন নর্দান আয়ার‌ল্যান্ডে। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ টহল দলে কাজ করতেন তিনি। ওই দলে একমাত্র তিনিই ছিলেন নারী।

র‌্যাচেলের যোগ দেওয়ার পর সহকর্মীরা লক্ষ করলেন ভিন্ন কিছু ঘটনা। পুরো দলের আচরণে রাতারাতি ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেল। পুরুষ সহকর্মীদের আচরণেও সংযম। তল্লাশিচৌকিগুলোতে স্থানীয় ব্যক্তিরা অনেকক্ষণ কথা বলেন তাঁর সঙ্গে। ওই সময় র‌্যাচেল এসব পরিবর্তনের বিষয়টি মোটেও টের পাননি। কয়েক বছর পর বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারেন, যখন তিনি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গোয় (ডিআরসি) জাতিসংঘের লিঙ্গসমতাবিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োজিত।

যুদ্ধক্ষেত্রে নারী সেনারা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে পারেন, সেটা কঙ্গোতে গিয়ে বেশ ভালোভাবে বুঝতে পারেন র‌্যাচেল। কঙ্গোয় কাজ করার সময় সেখানকার অনেক নারী ও শিশুকে তিনি দেখেছেন, যারা মূলত সেনাদের দ্বারা ধর্ষণের শিকার হয়ে সমাজচ্যুত। গ্রামের এক প্রান্তে ঠাঁই হয়েছে তাদের। কঙ্গোয় সেনাদের দ্বারা অনেক নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়। তাদের আর সমাজের মূলধারায় জায়গা হয় না।

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নারীদের অংশগ্রহণ অপরিহার্য। অথচ জাতিসংঘের পরিচালিত মিশনগুলো নারী শান্তিরক্ষীর সংখ্যা হাতে গোনা। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত মাত্র ২০ জন নারী নিয়োজিত ছিলেন এসব মিশনে। পরে অবশ্য সেই সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। বর্তমানে জাতিসংঘ মিশনে নিয়োজিত শান্তিরক্ষীদের মধ্যে ৫ শতাংশের মতো নারী। নারী শান্তিরক্ষী বাড়ানোর বিষয়ে দেশগুলোর সঙ্গে জাতিসংঘের দূতিয়ালি অব্যাহত রয়েছে। জাতিসংঘ মিশনে নারী সেনা পাঠানোর ক্ষেত্রে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির সেনাবাহিনীর প্রতি পাঁচজন কর্মকর্তার একজন নারী। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ১৬টি দেশ নারীদের সম্মুখযুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে, যা আগে পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত ছিল।

নারী সেনাসদস্যের সংখ্যা বাড়ায় ইতিবাচক ধারণার জন্ম দিয়েছে যে নারীরা দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এ ছাড়া যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলায় কমান্ডাররা নারীদের আস্থাভাজন হিসেবে মানতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে উন্নতি যত দ্রুত হওয়ার দরকার, ততটা হয়নি। আরও বেশি মৌলিক পরিবর্তন ও নারী সেনাদের প্রতি কিছু দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না আনলে এটা সম্ভবও নয়।

নারী সেনাদের এগিয়ে নিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে জাতিসংঘ। সামরিক বাহিনীতে ১৯৯৩ সালে যেখানে মাত্র ১ শতাংশ নারী ছিলেন, সেখানে ২০২৮ সালে ১৫ শতাংশে এবং পুলিশ বাহিনীতে ২০ শতাংশে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে বিশ্ব সংস্থাটি। ২০১৯ সালে এক অনুষ্ঠানে ভাষণে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, ‘এখানে শুধু সংখ্যার প্রশ্ন নয়, আমাদের প্রতিশ্রুতি পূরণের দক্ষতার বিষয়ও বটে।’

জাতিসংঘ মিশনে নারীদের নিয়োগ দেওয়ার বিষয়ে একটি স্মরণীয় ঘটনা হচ্ছে, ২০০৭ সালে ভারতের ১০৩ জন নারী পুলিশ সদস্যকে লাইবেরিয়ায় পাঠানো। এটাই জাতিসংঘের প্রথম নারী পুলিশ ইউনিট, যেখানে সবাই নারী। পরে অবশ্য বাংলাদেশের একটি নারী পুলিশ ইউনিটকে হাইতি ও কঙ্গোতে মোতায়েন করা হয়। এই উদ্যোগ অন্যান্য দেশেও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। কানাডার প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানের একজন লিঙ্গসমতাবিষয়ক উপদেষ্টা রয়েছেন। পশ্চিমা দেশগুলোর সামরিক জোট ন্যাটোতেও বিষয়টি অগ্রাধিকারের বিষয় হিসেবে দেখা হচ্ছে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল র‌্যাচেল বর্তমান ন্যাটোতে কর্মরত। ২০১৯ সাল পর্যন্ত জোটটির প্রধান কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন জেনারেল কার্টিস স্ক্যাপারোটি। নারীদের নিয়ে গঠিত একটি মার্কিন সেনাদল ইরাক ও আফগানিস্তানে মোতায়েনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেছেন, এই নারীদের সমাজ ও পরিবারে বড় ধরনের প্রস্তাব ছিল। কারণ, রক্ষণশীল ধ্যানধারণা ও সংস্কৃতি এখনো পুরুষ সেনাদের সঙ্গে নারী সেনাদের মেলামেশাকে সমর্থন করে না।

নারীদের বিশেষ কিছু পন্থায় যুদ্ধক্ষেত্র পরিচালনা করতে দেখা যায়। মালিতে জাতিসংঘ মিশনে উপদেষ্টা হিসেবে কর্মরত ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন লিজি মিলওয়াটার বলেছেন, নারী সেনারা পুরুষদের মধ্যে যেমন কাজ করতে পারেন, তেমনি কোনো ঝুঁকি ছাড়াই নারী ও শিশুদের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেন। তথ্য সংগ্রহ করতে পারেন। তল্লাশি করতে পারেন। যৌন নিপীড়ন বেড়ে যাওয়ার কারণে নারী সেনাদের প্রতি সহশীল আচরণ করেন নারীরা।

তবে অনেক সময় যুদ্ধক্ষেত্রে নারী সেনাদের সহায়ক হিসেবে দেখা হয়। জাতিসংঘ মিশনের গবেষণাগুলোতে দেখা গেছে, সাধারণত বেশির ভাগ সময় সংঘাত স্তিমিত হয়ে আসার পরই নারী শান্তিরক্ষীদের সেখানে পাঠানো হয়। যখন মিশনে নারীদের মোতায়েন করা হয়, তখন তাঁদের বেশির ভাগ ঘাঁটিতেই রাখা হয়। সম্মুখযুদ্ধে তাঁরা কমই অংশ নেন।

নিউইয়র্কের কর্নেল ইউনিভার্সিটির গবেষক সাবরিনা করিম গবেষণায় খুঁজে পেয়েছেন, নারীদের সম্মুখসমরে না পাঠানোর কারণ, কমান্ডারেরা মনে করেন, নারীরা বিপদ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারবেন না। এমনকি তাঁদের দায়িত্ব পালনেও বাধা দেওয়া হয়।

অনেকে আবার সমরে নারী সেনা মোতায়েনকে কোটা পূরণের পদ্ধতি হিসেবে দেখেন। পুরুষ সেনাদের অনেকে নারীদের যুদ্ধের জন্য মোতায়েনের উপযুক্ত বলেও মনে করেন না। নারীদের প্রেষণাও দেওয়া হয় না। অনেক ক্ষেত্রে আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণও পান না তাঁরা। আবার সংখ্যাও সীমিত থাকে। ফলে অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না। দুর্বলতার দুয়ো তুলে বিপজ্জনক এলাকাগুলোতে নারীদের মোতায়েন করতে অস্বীকৃতি জানানোকে সামরিক নেতৃত্বের ‘ভণ্ডামি’ বলে মনে করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল পিস ইনস্টিটিউটের গ্রিটচেন বোল্ডউইন। তিনি বলেছেন, সামরিক ঘাঁটিতে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে অবস্থান করার চেয়ে টহলে যাওয়া অনেক বেশি নিরাপদ মনে করেন নারীরা। সহকর্মীদের দ্বারা যৌন নিপীড়নের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এই ধারণা তাঁদের মধ্যে আরও বেড়েছে।

শান্তিরক্ষা মিশনে নারীরা উপযোগী কি না, সেই বিতর্ক জাতীয় সামরিক বাহিনীতে নারীদের ভূমিকাকে সামনে তুলে এনেছে। এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত যা দেখা যাচ্ছে, তা খুবই আশাজাগানিয়া। যুদ্ধে নারীদের ভূমিকা ব্যাপক কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ও সাবেক সেনা কর্মকর্তাদের ওপর একটি জরিপ চালানো হয় ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে। সেখানে দেখা গেছে, যুদ্ধক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকার পক্ষে বলেছেন ৭০ শতাংশ মানুষ। আর বাকি ৩০ শতাংশ বলেছেন বিপক্ষে। তবে অনেক দেশে বাস্তবতা ভিন্ন। অনেকে শান্তিরক্ষা মিশনের মতো কঠিন কাজে নারীদের পাঠানোর বিরুদ্ধে। তবে এটা ঠিক, নারীদের প্রতি গতানুগতিক যে দৃষ্টিভঙ্গি, তা রাতারাতি পাল্টে দেওয়া যাবে না। এ জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

সম্পর্কিত নিউজ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button