
নন্দন নিউজ ডেস্ক: সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলো কীভাবে বিশ্বের বহু স্বৈরশাসক, দুর্নীতিবাজ গোয়েন্দা কর্মকর্তা, নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা ব্যবসায়ী, মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী, মাদক ও মানব পাচারকারীর গোপন সম্পদ আগলে রেখেছে, সেই তথ্য আলোয় এনেছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি ব্যাংক ক্রেডিট সুইসের বিপুল পরিমাণ ফাঁস হওয়া নথি।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রেডিট সুইসের ১৮ হাজারের বেশি গ্রাহকের তথ্য রয়েছে এসব ফাঁস হওয়া নথিতে, তাদের অ্যাকাউন্টে জমা থাকা অর্থের পরিমাণ সব মিলিয়ে ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।
স্বঘোষিত এক ‘হুইসেল ব্লোয়ার’ এসব নথি সরবরাহ করে জার্মান সংবাদমাধ্যম সুইডডয়চে সেইটুংকে সরবরাহ করে। সেসব নথি বিশ্লেষণের কাজে এরপর যুক্ত হয় অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের সংগঠন অর্গানাইজিং ক্রাইম অ্যান্ড করাপশন রিপোর্টিং প্রজেক্ট এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস, গার্ডিয়ান, লা মঁদেসহ ৩৯ দেশের ৪৮টি সংবাদমাধ্যম।
সবার পরিশ্রমে রোববার পত্রিকাগুলো একযোগে প্রকাশ করে ‘সুইস সিক্রেটস’, যেখানে ১৯৪০ এর দশক থেকে ২০১০ এর মধ্যে ক্রেডিট সুইসে খোলা এসব অ্যাকাউন্টের ৩০ হাজারের বেশি মালিকের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে।
সারা পৃথিবীতে ধনী ব্যক্তিদের টাকা সুইস ব্যাংকে রাখার আগ্রহের পেছনে মূল কারণ দেশটির গোপনীয়তার নীতি। সুইজারল্যান্ডের আইনে ব্যাংকগুলো তাদের গ্রাহকদের তথ্য প্রকাশ করতে বাধ্য নয়। টাকার উৎসও তারা জানতে চায় না।
গার্ডিয়ান লিখেছে, সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তার নীতি যে ‘অনৈতিকভাবে’ অবৈধ সম্পদেরও সুরক্ষা দিচ্ছে, তাই প্রকাশ্যে এনেছে ‘সুইস সিক্রেটস’।
এসব অ্যাকাউন্টের মালিকদের মধ্যে রয়েছেন জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ, তার দুই ছেলে এবং মিশরের সাবেক স্বৈরশাসক হোসনি মুবারকের নাম।
নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, বাদশা মোবারকের নামে ছয়টি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে, যার একটিতে ২২ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বেশি জমা ছিল।
মোবারকের দুই ছেলে আলা ও জামালের নামে ছয়টি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে ফাঁস হওয়া নথিতে,যার একটিতে ২০০৩ সালে জমা ছিল ১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
জর্ডানের জেনারেল ইন্টেলিজেন্স ডিরেক্টরেটের সাবেক প্রধান সাদ খাইর, পাকিস্তানের আইএসআই এর সাবেক প্রধান জেনারেল আখতার আবদুর রহমান, মিশরের ওমর সুলেইমান, ইয়েমেনের গালিব আল কামিশ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের তথ্যও এসেছে সুইস সিক্রেটে।
সত্তরের দশকের শেষভাগে সিআইএ যখন আফগানিস্তানে সোভিয়েতবিরোধী মুজাহিদিনদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছিল, এবং পরে ১৯৯০ এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র যখন উপসাগরীয় অঞ্চলে যুদ্ধে জড়াল, ওই চার গোয়েন্দা কর্মকর্তা যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আফগানিস্তান আর মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিতে সহযোগিতা করেন।
পাকিস্তানের আখতার আবদুর রহমান খানের দুই ছেলে আকবর ও হারুন খানের ক্রেডিট সুইসের অ্যাকাউন্টে সে সময় ৩৭ লাখ ডলার জমা হয়েছিল। জর্ডানের সাদ খাইরের একটি অ্যাকাউন্টে ছিল ২ কোটি ১৬ লাখ ডলার।
সুইস সিক্রেটস এর অনুসন্ধানে সাংবাদিকরা আরও অন্তত ৪০ জনের নাম পেয়েছেন, যারা ডজনখানেক দেশের গোয়েন্দা দপ্তারের কর্মকর্তা ছিলেন বিভিন্ন সময়ে।
এদের মধ্যে ভেনেজুয়েলার সাবেক আর্মি ক্যাপ্টেন কার্লোস লুই অ্যাগুইলেরা বোর্হাস ১৯৯০ এর দশকে ছিলেন প্রেসডেন্ট উগো চাভেজের দেহরক্ষী। ইউক্রেইনের সিকিউরিটি সার্ভিসের সাবেক প্রধান ভ্যালেরি খোরশকোভস্কি এখন একজন বিজনেস টাইকুন। মিশররের সাবেক গুপ্তচর আশরাফ মারওয়ান ছিলেন প্রেসিডেন্ট জামাল আবদেল নাসেরের জামাতা।
এছাড়া, জার্মানি, নাইজেরিয়া, উজবেকিস্তান, ইরাক, জর্ডান, ইয়েমেনের বেশ কয়েকজন গোয়েন্দা কর্মকর্তার নাম এসেছে সুইস সিক্রেটসে।
এছাড়া ভেনেজুয়েলার সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী নের্ভিস ভিয়ালোবোস, আলজেরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী খালেদ নজর, বান্ধবীকে হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত মিশরীয় রাজনীতিবিদ হিশাম তালাত এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞায় থাকা জিম্বাবুয়ের এক ব্যবসায়ীর নামও রয়েছে।
ভ্যাটিকানের মালিকানাধীন একটি অ্যাকাউন্টের তথ্যও এসেছে ফাঁস হওয়া নথিতে। ওই অ্যাকাউন্ট থেকে ৩৫ কোটি ইউরোপ ব্যয় করা হয়েছে লন্ডনের একটি সম্পত্তি কিনতে, যেখানে দুর্নীতির অভিযোগে এক কার্ডিনালসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে।
গার্ডিয়ান লিখেছে, ক্রেডিট সুইসের ১৫ লাখ গ্রাহকের মধ্যে কেবল একটি অংশের তথ্যই এসেছে ফাঁস হওয়া নথিতে। অ্যাকাউন্ট মালিকদের অনেকে মারা গেছেন, অনেক অ্যাকাউন্ট বন্ধও হয়ে গেছে। তবে অনেক অ্যাকাউন্ট এখনও চালু রয়েছে।
অবৈধ সম্পদের সুরক্ষা দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করে ক্রেডিট সুইসের মুখপাত্র ক্যানডাইস সান এক বিবৃতিতে বলেছেন, ফাঁস হওয়া তথ্যে যেসব অ্যাকাউন্টের কথা এসেছে, তার অনেকগুলোই কয়েক দশক আগের। সে সময় আইন, ব্যাংকিং নীতিমালা এবং আর্থিক খাতের কাছে প্রত্যাশার বিষয়গুলো ‘অন্যরকম’ ছিল।
গত সাত বছর ধরে ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপার্স, পানামা পেপার্স, লাক্সলিকস এবং প্যান্ডোরা পেপার্স প্রতিবেদনে অনেকের গোপন সম্পদের অনেকটাই ফাঁস করেছে।
২০১৬ সালে যখন পানামা পেপার্স ঝড় তুলেছিল, তখন এটাও বলা হয়েছিল- ল’ ফার্ম মোস্যাক ফনসেকার কোটি নথি ফাঁস ‘গল্পের অর্ধেকটা’ মাত্র।